শনিবার, ২৪ মে, ২০১৪

শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে অনুরোধ : জাফর ইকবাল

এই নিয়ে পর পর তিনবার আমি একই বিষয় নিয়ে লিখছি, বিষয়টি হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস। প্রথমবার আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন আর এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন পাশাপাশি বসিয়ে পত্র-পত্রিকায় পাঠিয়েছি। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার এরকম অকাট্য একটা প্রমাণ পাবার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কিছু একটা করতে হবে বলে আমার ধারণা ছিল। আমার ধারণাটা ভুল ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু করেনি। আমি দ্বিতীয়বার তাই আরেকটু বড় করে লিখেছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সরাসরি কয়েকটা প্রশ্নও করেছি, তারা আমাকেই তার উত্তর দিবে আমি সেটা কখনো ভাবিনি কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সেটা অন্তত মেনে নিবে এরকম আশা ছিল। আমার আশা পূরণ হয়নি, হয়তো লেখাটা তাদের চোখে পড়েনি। এবারে তাই লেখার শিরোনামে 'শিক্ষামন্ত্রী' কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছি, নিশ্চয়ই কারো চোখে পড়বে। আমার অবশ্য আরো একটা উদ্দেশ্য আছে এই দেশের যে অসংখ্য ছেলে মেয়ে এই মুহূর্তে এইচএসসি পরীক্ষা নামে প্রহসনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে আমি তাদেরকে জানাতে চাই, সেই প্রহসনের জন্য আমাদের কারো বুকের মাঝে আত্মতৃপ্তি নেই, তারা যেরকম হতাশা, ক্ষোভ আর যন্ত্রণায় ছটফট করছে আমরাও ঠিক একইভাবে হতাশা ক্ষোভ আর যন্ত্রণায় ছটফট করছি।

প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিয়ে আমি প্রথম যে লেখাটা লিখেছিলাম তখন আমার হাতে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নগুলো ছিল। এখন রসায়নের প্রশ্ন আছে। এগুলোও আমি পত্র-পত্রিকায় দিতে পারতাম কিন্তু কোনো লাভ হবে না বলে নোংরা ঘাটাঘাটি করতে ইচ্ছে করছে না। সবচেয়ে বড় কথা ফেসবুক থেকে যখন যার প্রয়োজন এগুলো নামিয়ে নিতে পারবে আমার দেয়া না দেয়াতে কিছু আসে যায় না।

একটা ব্যাপার আমার কাছে এখনো রহস্যের মত মনে হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি খুবই ভয়ানক একটা ব্যাপার, আমি ভেবেছিলাম এটা নিয়ে বুঝি সারা দেশে তুলকালাম ঘটে যাবে কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম কিছুই ঘটেনি। পত্র-পত্রিকার বা মিডিয়ার যে সব মানুষজনকে আমি চিনি তাদেরকে ফোন করে আমি ব্যাপারটা জানতে চাইলাম তারাও ব্যাপারটা আমাকে বোঝাতে পারলেন না। আচ্ছা আচ্ছা ভাবে মনে হল সবাই ধরেই নিয়েছে এরকমই ঘটতে থাকবে এবং যেহেতু চেঁচামেচি করে কিছুই হবে না, তাহলে খামোকা চেঁচামেচি করে কী হবে? কি সর্বনাশা কথা! আমিও ব্যাপারটা খানিকটা অনুমান করতে পারি, যে দেশে সরকারের র্যাব বাহিনী সরকারের পুরো প্রশাসনকে ব্যবহার করে এক দুইজন নয় সাত সাতজন নিরপরাধ মানুষকে প্রকাশ্য দিনের বেলায় সবার সামনে ধরে নিয়ে খুন করে নদীর তলায় ডুবিয়ে রাখতে হাত লাগায় সেই দেশে কী এখন 'তুচ্ছ' পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে বিচলিত হবার সময় আছে?

তারপরেও আমার মনে হয় আমাদের বিচলিত হতে হবে। তার কারণ একজন তরুণ কিংবা-তরুণী যদি তার স্বপ্ন দেখার বয়সটিতেই আশাহত হয়, হতাশাগ্রস্ত হয়, অপমানিত হয়, ক্ষুব্ধ হয় কোনো কারণ ছাড়াই তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকে তাহলে সে কেমন করে বেঁচে থাকবে? এইচএসসি-এর প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে শুরু করার পর অসংখ্য ছেলে মেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে তাদের ক্ষোভ-অভিযোগ-হতাশা আমাকে জানিয়েছে। আমি এর আগে সবসময়েই সবাইকে আশার কথা শুনিয়ে এসেছি, এই প্রথমবার আমি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছি না। আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন ই-মেইল পাঠিয়েছে একজন ছাত্রী। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পরও সে নিজের সততার কাছে মাথা উঁচু করে থেকেছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন সে দেখেনি, নিজের মত করে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষা দেওয়ার পর জানতে পেরেছে তার চারপাশের সবাই ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে এসেছে, সবার পরীক্ষা 'ভালো' হয়েছে—শুধু তার পরীক্ষা ভালো হয়নি, প্রশ্নপত্র কঠিন ছিল ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। মেয়েটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে জানার পরও যেহেতু পরীক্ষা বাতিল হয়নি, বাতিল হবে সেরকম কোনো আলোচনাও নেই, তার অর্থ সবাই পার হয়ে যাবে শুধু সে পার হবে না। সততার জন্য সে খুব বড় একটা মূল্য দেবে, ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাবে না, জীবনের স্বপ্নটি শুরু হবার আগেই ধূলিসাত্ হয়ে যাবে। আমি তাকে কী বলে সান্ত্বনা দেব? তাকে বলব, বাংলাদেশে এটাই নিয়ম? এই দেশে আমরা সত্ মানুষের জীবনটা ইচ্ছে করে ছারখার করে দেই? আমি একে বলব যে, তোমার অসত্ হওয়া উচিত ছিল, তুমি নির্বোধের মত সত্ থেকেছ এখন তার জন্য মূল্য দাও? কেউ একজন আমাকে কী বলবে, আমরা কী আনুষ্ঠানিকভাবে একটা জাতিকে অসত্ বানিয়ে দেয়ার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি? আমরা কী অন্যায়কে অন্যায়ও বলতে পারব না?

সম্ভবত অন্য সবার মত আমারও হাল ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। বলা উচিত ছিল যেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনোই স্বীকার করেনি যে, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, উল্টো সবাইকে উপদেশ দেয়া হয়েছে গুজবে কান না দিতে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদেরকে শাস্তি দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। সেই হিসেবে আমি হয়তো রাষ্ট্রের চোখে শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করার দোষে দোষী একজন মানুষ। আমার হয়তো লম্বা লম্বা কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডিজিটাল বাংলাদেশ জাতীয় বড় বড় কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত ছিল। কিন্তু যতবার আমি এই দেশের ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবি, যারা অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে সত্যিকার ছাত্র বা ছাত্রীর মত লেখাপড়া করে নিজের ভবিষ্যেক ধ্বংস করেছে ততবার আমার মনে হয় কিছুতেই এই বিষয়টাকে ভুলে যেতে দেয়া যাবে না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে, যেন কর্তৃপক্ষ আগে হোক পরে হোক এই বিষয়টার দিকে নজর দেয়। এটি মোটেও এমন একটি বিষয় নয় যে, অল্প কিছু দুর্নীতিবাজ মানুষ তাদের অল্প কয়জন দুর্নীতিবাজ ছেলে-মেয়েদেরকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীর তুলনায় তাদের সংখ্যা এতো কম যে, এই বিষয়টা উপেক্ষা করলেও সত্যিকার অর্থে দেশের এমন কিছু ক্ষতি হবে না। এটি মোটেও তা নয়, আজকাল বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ফেসবুক একাউন্ট আছে তারা এই ফেসবুক একাউন্ট ব্যবহার করে চোখের পলকে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র নামিয়ে আনছে। নামিয়ে আনার পর একে অন্যকে পৌঁছে দিয়েছে। যাদের কম্পিউটার ইন্টারনেট নেই তাদের ফ্যাক্স ফটোকপি আছে কাজেই লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ের হাতে এগুলো পৌঁছে গেছে।

এটি উপেক্ষা করা যায় সেরকম একটি সমস্যা নয়, এটি এই দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে সেরকম একটি সমস্যা।

আমি এই লেখাটি লিখছি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। আমাদের দেশে যে কয়জন মন্ত্রী সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি তাদের একজন। জনপ্রিয় মন্ত্রীদের নিয়ে যখনই জরিপ করা হয় তিনি তখন সবার উপরে থাকেন। তার কারণও আছে, স্কুল-কলেজের লেখাপড়া নিয়ে তার আগ্রহ আছে। বছরের প্রথমদিন তার কারণে বাংলাদেশের সব ছেলে-মেয়ে হাতে নতুন বই পেয়ে যায়। শুধু বইয়ের সংখ্যা দেখলে পৃথিবীর যে কোনো মানুষের মাথা ঘুরে যাবে। বইগুলো একটার পর আরেকটা রাখা হলে সারা পৃথিবী দুইবার ঘুরে আসবে—বাচ্চাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য আমি সুযোগ পেলেই তাদের এই কথাটা বলে অবাক করে দিয়েছি। আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলেজ উদ্বোধন করতে গিয়েছি। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমি তার পাশে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের ডিগ্রী পেতে দেখেছি। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সাথে আমিও তার কথা শুনে দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। কাজেই প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারটা তার নজরে আনা হলে তিনি কিছু একটা করবেন না, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। তাই আমি অনেক আশা করে এই লেখাটি লিখছি। আমি আশা করছি, তিনি কষ্ট করে হলেও এই লেখাটুকু পড়বেন।

আমি তার কাছে বেশি কিছু চাই না, ছোট একটা বিষয় চাই। তিনি শুধু একটা সত্যি কথা বলবেন, জাতিকে জানাবেন এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। আমি চাই এই দেশের ছেলে-মেয়েরা অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে জানতে শিখুন, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে নিতে শিখুন। তার বেশি কিছু নয়। একটা দেশের পুরো প্রজন্মকে যদি আমরা অনৈতিক হিসেবে গড়ে তুলি তাহলে সেই দেশকে নিয়ে আমরা কী করব?

যদি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাবার ঘটনাটি মেনে নেন তাহলে যারা প্রশ্ন ফাঁস করেছে তাদেরকে ধরার চেষ্টা করা যাবে। আমি এই দেশের একটা সত্যি কথা জানি, যদি কোনো অপরাধীকে ধরার ইচ্ছে থাকে তাহলে তাদের ধরা যায়। যেসব অপরাধীকে ধরা যায় না তাদেরকে আসলে ধরার চেষ্টা করা হয় না। আমরা আশা করব, এই ঘটনার তদন্ত হবে, অপরাধীদের ধরা হবে, তাদের শাস্তি হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কখনো এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেটি নিশ্চিত করা হবে। আমি জানি এটি করা সম্ভব।

এমনটি কী হতে পারে যে, এই লেখাটি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর চোখে পড়ল না? কিংবা তার চাইতেও দুঃখজনক একটা ব্যাপার ঘটল, লেখাটি তার চোখে পড়ল, কিন্তু তার পরেও তিনি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটা স্বীকার করলেন না —তাহলে আমরা কী করব?

অন্যেরা কী করবে জানি না, কিন্তু আমি কী করব মনে মনে ঠিক করে রেখেছি। তাহলে আমি শহীদ মিনার কিংবা এরকম কোনো একটা জায়গায় খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে থাকব। হাতে একটা প্ল্যাকার্ড রাখব সেখানে লিখব, "প্রশ্ন ফাঁস মানি না, মানব না। আমাদের ছেলে-মেয়েদের অসত্ হতে দেব না।"

তাতে কী কোনো লাভ হবে? সম্ভবত হবে না। যখন এই দেশের ছেলে-মেয়েরা ক্ষুব্ধ চোখে আমাকে বলবে, "স্যার, আমরা এ কেমন দেশে বাস করি? কেন এতো বড় অন্যায় আমাদের মেনে নিতে হবে?"

আমি তখন অন্তত তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলব, "তোমরা আমাকে ক্ষমা করো — আমি কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন